সংগীতের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - সংগীত - সংগীতের ইতিহাস | NCTB BOOK

শাস্ত্রীয়সংগীতের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

সংগীত শুধু শিল্পকলাই নয়, বিজ্ঞানও বটে। এই বিজ্ঞানভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠতে বহুযুগ অতিবাহিত হয়েছে। এ কথা ঠিক যে, মানুষের কণ্ঠে সর্বপ্রথম নির্গত হয়েছিল ধ্বনি এবং সুর, তারপর এসেছে কথা বলার ভাষা। আদিকাল থেকে মানুষের কন্ঠে স্বরের সৃষ্টি থেকে সংগীতের যাত্রা। প্রকৃতপক্ষে, মানুষ সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই কণ্ঠ সংগীতের জন্ম। কারণ মানুষ ভাষা সৃষ্টির হবার আগেই সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, রাগ-অনুরাগ প্রকাশ করার জন্য স্বর ব্যবহার করত। উপমহাদেশে প্রাচীন সভ্যতা যেমন বিভিন্ন ধারায় উৎকর্ষ লাভ করেছে, শাস্ত্রীয়সংগীতের ক্রমবিকাশ ঠিক তেমনিভাবে হয়েছে। শাস্ত্রীয়সংগীতের ক্রমবিবর্তনের ধারাকে মোটামুটিভাবে পাঁচ পর্যায়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশিষ্ট সংগীত গবেষক স্বামী প্রজ্ঞানানদের মত অনুযায়ী: ১। আদিম ও প্রাক-বৈদিক বা সিন্ধু সভ্যতার যুগ (খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০)।

২। বৈদিক যুগ (খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০),

৩। বৈদিকোত্তর বা পৌরাণিক যুগ (খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০- ১২০৬ খ্রিষ্টপূর্ব),

৪। মধ্যযুগ (১২০৭ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ১৭৫৭ খ্রিষ্টপূর্ব) এবং ৫। বর্তমান বা আধুনিক যুগ (১৭৫৮ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে চলমান )

প্রথম তিন পর্যায়কে 'প্রাচীন যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করে সংগীতের ইতিহাস রচিত হয়েছে। নিজে প্রাচীন যুগ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

প্রাচীন যুগ

(ক) প্ৰাক-বৈদিক বা সিন্ধু সভ্যতার যুগ: আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০-১৫০০ পর্যন্ত প্রাক-বৈদিক বা সিন্ধু সভ্যতার যুগ বলা হয়। এই প্রাক-বৈদিক যুগে মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার ধ্বংসস্তূপ থেকে যে সব সংগীতের উপাদান পাওয়া গেছে তা থেকে অনুমান করা যায় তৎকালীন সমাজে চারুকলা ও সংগীত অনুশীলনের চেতনা যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল। তৎকালীন সমাজে নৃত্য, গীত ও বাদ্যের চর্চা পরিশীলিত ও উন্নত মানের ছিল এবং অনুমান করা যায় যে, তখন একাধিক স্বর বিশিষ্ট সংগীতের প্রচলন ছিল। কয়েকটি ছিদ্রযুক্ত বাঁশি এই সভ্যতার স্মৃতি-চিহ্নই প্রমাণ করে যে তখন সংগীতের স্বপ্নের বিকাশ ঘটেছিল। প্রাপ্ত নিদর্শনের দু-তিন বা তিন-চারটি তারযুক্ত কয়েকটি বীণা, মৃদঙ্গাদি, চামড়ার বাদ্যযন্ত্র, করতাল, একটি ব্রোঞ্জের নৃত্যশীলা নারী ও নৃত্যরত নর্তকের ভগ্নমূর্তি উল্লেখযোগ্য।

(খ) বৈদিক যুগ: আর্যদের আগমনের ফলে মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসস্তূপের ওপর গড়ে ওঠে বৈদিক সভ্যতা। বেদের জোনগুলো গানের মতো সুর করে যজ্ঞানুষ্ঠানে গাওয়া হতো। খ্রি. পূ. ৩০০ থেকে ৫০০ শতকের মধ্যে উৎপত্তি হয়েছিল গান্ধর্বসংগীত। ইতিহাসবিদদের মতে, এদেশের ললিতকলার উৎকর্ষতা মৌর্যযুগ থেকে (খ্রি. পূর্ব ৩২৪) শুরু করে গুপ্ত রাজত্বকালের (৪র্থ শতক) শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

বৈদিক যুগের গান বলতে আমরা বুঝি সামগান। প্রধানত যজ্ঞানুষ্ঠানে সামগান গাওয়া হতো। বৈদিক প্রাতিশাখ্য তথা নারদীয় শিক্ষা, পাণিনি, মাকুরী প্রভৃতি শিক্ষাগুলো থেকেই সে সময়ের সংগীত সম্বন্ধে পণ্ডিতেরা যা লিখে গেছেন, তা থেকে জানা যায় যে, এই যুগে মাত্র তিনটি স্বর দিয়ে সামগান গাওয়া হতো।

সামিক যুগে ব্যবহৃত তিনটি স্বরকে উদাত্ত, অনুদাত্ত ও স্বরিত নামে অভিহিত করা হতো। উদাত্ত ছিল সর্বোচ্চ স্বর, অনুদাত্ত নিচু স্বর এবং স্বরিত উপাত্ত অনুদান্তের মধ্যবর্তী স্বর। সংগীতজ্ঞগণ বলেন যে, এই উদাত্ত, অনুদাত্ত ও স্বরিতের মধ্যেই সাতটি স্বরের সমন্বয় পাওয়া যায়। যেমন- উদাত্ত স্বরের অন্তর্গত ছিল গান্ধার ও নিষাদ, অনুদাত্ত স্বরের অন্তর্গত অষত ও ধৈবত এবং স্বরিত স্বরের অন্তর্গত ছিল বড়জ, মধ্যম ও পঞ্চম। এই তিনটি আদি স্বর থেকেই পরবর্তীকালের সাত স্বরের উদ্ভব হয়েছে।

(গ) বৈদিকোত্তর যুগ: বৈদিক যুগকে অনেকে বলেন অতি প্রাচীন যুগ। সংগীতের চর্চা যে এই যুগেও অব্যাহত ছিল তা বোঝা যায় এই যুগের গ্রন্থে সংগীতের উল্লেখ দেখে। এদের মধ্যে ভরতের 'নাট্যশাস্ত্র' নারদের 'সংগীত মকরন্দ' ও 'নারদীয় শিক্ষা", মতঙ্গের 'বৃহদ্দেশী' ইত্যাদি গ্রন্থে এই যুগের সংগীতের বিস্তৃত পরিচয় পাওয়া যায়। তাছাড়া, এই সময়ে দক্ষিণ ভারতের তামিল গ্রন্থ 'পারিপাতন'-এ সংগীত সম্বন্ধীয় বিস্তারিত আলোচনা দৃষ্ট হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ শতাব্দীর বৌদ্ধ নাটক 'সিলাপহিগারম' গ্রন্থে পীত এবং বিভিন্ন বাদ্যের উল্লেখ আছে।

ভারতের সময়কাল নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ বিদ্যমান। অনেকের মতে, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে 'নাট্যশাস্ত্র' লেখা হয়। ভারতের নাট্যশাস্ত্রে 'রাগ' নামটির কোনোও উল্লেখ পাওয়া যায় না। তিনি ষড়জ এবং মধ্যম গ্রামের উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া শ্রুতি, স্বর, মূর্ছনা, নৃত্য, নাট্য ইত্যাদির বিস্তৃত বর্ণনা নাট্যশাস্ত্রে পাওয়া যায়। বিকৃত স্বরগুলোর মধ্যে ভরত মাত্র দুটো স্বরের উল্লেখ করেছেন- 'অন্তর গান্ধার' ও 'কাকলী নিযাম' সংগীত সম্বন্ধীয় আলোচনার প্রথম প্রামাণিক গ্রন্থের মর্যাদা দেওয়া হয় ভরতের 'নাট্যশাস্ত্র' গ্রন্থকে।

'বৃহদ্দেশী' গ্রন্থেই সর্বপ্রথম 'রাগ' শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। মতঙ্গও গাজার গ্রামের উল্লেখ করেছেন এবং গ্রাম

মূর্ছনার বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তিনিও সাতটি জাতির উল্লেখ করেছেন, টকী, সাধীরা, মানবপঞ্চম, ষাড়ব,

বটরাগ, হিন্দোলক এবং টককৌশিক।

এর পরেই সপ্তম শতাব্দীর কাছাকাছি যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থটি পাওয়া যায় তা হচ্ছে নারদের 'নারদীয় শিক্ষা" । এই গ্রন্থে শ্রুতি, স্বর ইত্যাদির উল্লেখ আছে এবং তিনি সাতটি গ্রাম রাগের বর্ণনা করেছেন।

নারদের দ্বিতীয় গ্রন্থ 'সংগীত মকরণ'-এ প্রথম রাগ-রাগিণীর বর্ণনা পাওয়া যায়।

এ যুগের অন্যান্য গ্রন্থাদির মধ্যে পুণ্ডরীক বিটালের ৪টি গ্রন্থ 'রাগমালা', 'রাগমঞ্জরী', 'নর্তন নির্ণয়' ও 'সদ্রাণ চন্দ্রোদয়': দামোদরের 'সংগীতদর্পণ', সোমনাথের 'রাগবিরোধ, অহোবলের 'সংগীত পারিজাত', ব্যাঙ্কটমুখীর 'চতুর্দন্তী প্রকাশিকা', হৃদয়নারায়ণ দেবের 'হৃদয় প্রকাশ' ও 'হৃদয় কৌতক' পণ্ডিত ভাবভট্টের 'অনুপবিলাস, 'অনুপঙ্কুশ' এবং 'অনুপসংগীত রত্নাকর', শ্রীনিবাসের 'রাগতত্ত্ববিবোধ' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

মধ্যযুগ

মধ্যযুগে সংগীতের অভাবিত প্রসার এবং উন্নতি হয়েছিল। একদিকে যেমন ছিলেন দিকপাল সংগীতজ্ঞরা, অপরদিকে সংগীতের সকল বিভাগ অর্থাৎ নৃত্য, গীত এবং বাদ্য নতুন নতুন সৃষ্টি সম্ভারে পরিপূর্ণ হয়েছিল। এ-যুগে মুসলমানদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি।

১১শ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮শ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সংগীতের ইতিহাস মধ্যযুগ বা মুসলমান যুগ বিবেচনা করা হলেও এর অনেক আগেই উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমন ঘটে। ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে মুহম্মদ বিন কাশেমের সিন্ধু বিজয় ও একাদশ শতকে মুহম্মদ ঘোরীর আগমনের মধ্য দিয়ে সংগীতের ওপর মুসলমান সংস্কৃতি প্রভাব বিস্তার করে। বিজয়ী মুসলমানদের সঙ্গে করে নিয়ে আসা অনেক প্রকার আরব্য-পারসিক ও তুর্কি বাদ্যযন্ত্র ছিল এবং যেগুলোর সাথে উপমহাদেশীয় সংগীতের সাদৃশ্য ছিল। মুসলমানদের প্রভাবে ভারতীয় সংগীত এক নতুন রূপ লাভ করে। আধুনিককালে পাশ্চাত্যের প্রভাব যেমন বিভিন্ন শৈলীর গানে শোনা যায়, মুসলমান বিজয়ের ফলে ভারতীয় সংগীতের অনুরূপ নানা পরিবর্তন লক্ষণীয়। এই সময়ে ভারতীয় শাস্ত্রীয়সংগীতের ক্ষেত্রে শৈলীগত পরম্পরার বিকাশে ঘরানার উন্মেষ ঘটতে শুরু করে।

সংগীতের উন্নয়নে সাধনা এবং পৃষ্ঠপোষকতার অসাধারণ অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল এই মধ্যযুগে। এই সময়ে সংগীতজ্ঞদের মধ্যে গ্রন্থ রচয়িতা হিসেবে রয়েছেন পণ্ডিত শার্জদেব, পার্শ্বদেব, করিলোচন, পুণ্ডরীক বিতল, কল্লিনাথ, অহোবল, ব্যাঙ্কটমুখী, সোমনাথ, দামোদর, কোহল, রামামাত্য, শ্রীনিবাস, হৃদয় নারায়ণ দেব, ভাবভ প্রমুখ সংগীতশাস্ত্রী। অন্যদিকে সংগীত পরিবেশনায় সিদ্ধ সাধকগণের মধ্যে রয়েছেন আমীর খসরু, বৈজুবাওরা, নায়ক গোপাল, রাজা মানসিংহ তোমর, সুলতান হুসেন শাহ্ শর্কী, স্বামী হরিদাস, তানসেন, জগন্নাথ কবি রায়, বিলাস খাঁ, নিয়ামত (সদারঙ্গ), অদারঙ্গ, মনরঙ্গ, গোলাম রসুল, গোলাম নবী (শোরী মিঞা), কাশিম আলী খাঁ, বাহাদুর সেন প্রমুখ।

শাস্ত্রীয়সংগীতের উন্নয়ন ও বিকাশে রাজ-পৃষ্ঠপোষকতার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। দিল্লীর সুলতান থেকে শুরু করে রাজা-মহারাজা, সামন্ত শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতায় রাজ-দরবার থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে সংগীত প্রসার লাভ করেছিল।

শাঈদের

মধ্যযুগে সংগীতের ইতিহাসে যে কয়জন সংগীতশাস্ত্রবিদ তাঁদের কীর্তির জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁদের মধ্যে পণ্ডিত শার্জনের (এয়োদশ শতক) অন্যতম। প্রাচীনকালের সংগীত গ্রন্থ 'ভরতের নাট্যশাস্ত্র' যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি মধ্যযুগে শাঈদের রচিত 'সংগীত-রত্নাকর' ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত ও অবিস্মরণীয় গ্রন্থ। দেবগিরি রাজ্যের রাজ পৃষ্ঠপোষকতায় (১২১০-১২৪৮ খ্রি.) গ্রন্থটি রচিত। এই গ্রন্থ পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত স্বর, রাগ, তাল, বাদ্য ও নৃত্য। এই গ্রন্থে গন্ধর্ব ও প্রাচীন ধারার সংগীতকে ব্যাখ্যা করে নতুন ধারার সংগীত পদ্ধতির পূর্ণ তারিক রূপ প্রদান করেছেন শার্জদেব। গ্রন্থটিতে সংগীতের নানা বিষয়ের তথ্যপূর্ণ আলোচনা পাওয়া যায় যেমন- নাদের উৎপত্তি, স্বরূপ, শ্রুতি, মূর্ছনা, জাতি, তত্, শুধির, আনত্ব, ঘন ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের বর্ণনা, নৃত্যকলা ইত্যাদি।

আলাউদ্দিন খিলজির শাসনামল (রাজত্বকাল: ১২৯৬-১৩১৬)

আলাউদ্দিন খিলজি একজন বিচক্ষণ, বিদ্যোৎসাহী ও শিল্পানুরাগী সুলতান ছিলেন। তাঁর শাসনামলে শাস্ত্রীয় ধারায় আমূল পরিবর্তন আসে। তিনি ১২৯৬ থেকে ১৩১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ভারতবর্ষের দক্ষিণ অঞ্চল সে সময়ে প্রখ্যাত সংগীত শিল্পীদের আবাসভূমি বলে পরিচিত ছিল। নায়ক গোপালসহ বহু সংগীতবিদ, জ্ঞানী-গুণী ও পণ্ডিতবর্গ এই বিজয়ের ফলে রাজদরবারে সমাদৃত হন। তাঁর রাজদরবারে প্রতিভাবান সংগীতগুণি- আমীর খসরু, বৈজুবাগুরা, নায়ক গোপাল প্রমুখের উপস্থিতির কারণে হিন্দু-মুসলিম সংগীত ধারার সমন্বয় সাধন হয়।

আমীর খসরু ভারতীয় শাস্ত্রীয়সংগীতের একজন যুগস্রষ্টা প্রতিভা। তিনি এই উপমহাদেশের প্রচলিত সংগীত

ধারার সাথে আরবি, ফার্সি ও তুর্কি সংগীত ধারার সংমিশ্রণে এক অভিনব ও প্রশংসিত বিপ্লব আনেন।

নায়ক গোপাল (১২০৫-১৩১৫) সংগীতের ইতিহাসে গোপাল নায়ক ও নায়ক গোপাল অভিন্ন ব্যক্তি কি-না এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। 'মআপনুল মৌসিকী' গ্রন্থের রচয়িতা হাকিম মোহাম্মদ করম ইমাম গোপাল নায়ক ও নায়ক গোপালকে ভিন্ন দুজন ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অনেকের অনুমান গোপাল নায়ক ত্রয়োদশ শতাব্দীর সংগীতজ্ঞ ছিলেন। নায়ক তাঁর বংশগত উপাধি। 'নায়ক' উপাধি উড়িষ্যা এবং দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত। তাই অনুমিত হয় গোপাল দাক্ষিণাত্যের দেবগিরি অঞ্চলের রাজা রামদের যাদবের সভাগায়ক ছিলেন। আলাউদ্দিন খিলজির সেনাপতি মল্লিক কাপুর গোপাল নায়কের গায়নশৈলীতে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে দিল্লীতে নিয়ে আসেন। তখন আলাউদ্দিন লিজি দিল্লীর সুলতান। আলাউদ্দিন খিলজি রামদেবকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। নায়ক গোপাল আমীর খসরুর সমসাময়িক ছিলেন।

আবার কোনো কোনো সংগীতজ্ঞের মতে, গোপাল নায়ক চতুর্দশ শতাব্দীর সংগীতগুলি এবং তাঁর কর্মস্থল ছিল। বিজয় নগর রাজসভা। তবে সংগীতে গোপাল নায়কের অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি বহু রাগের স্রষ্টা, যেমন- পটমঞ্জরী, যোগিয়া, পিলু, বড়হংস সারং ইত্যাদি। 'রাগকদম' গ্রন্থ ও নতুন গীত রচনার পাশাপাশি নতুন গায়কীর প্রবর্তন করেছিলেন নায়ক গোপাল।

বৈজু বাওরা

বৈজু নামে একাধিক সংগীতজ্ঞের নাম প্রচলন আছে এবং প্রচলিত সকল বক্তব্যই কিংবদন্তিতে আচ্ছন্ন। তবে বৈজু বাওরা বা নায়ক বৈষ্ণু নামে খ্যাত ব্যক্তিই পরবর্তীকালে স্থায়ী খ্যাতি লাভ করে। তিনি ত্রয়োদশ শতকে সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজির সময়ে জীবিত ছিলেন। আলাউদ্দিন খিলজি তাঁকে তাঁর দরবারে আমন্ত্রণও করেছিলেন। তবে বৈষ্ণু স্থায়ীভাবে দরবারে অবস্থান না করলেও মাঝে মাঝে দরবারে যেতেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। কোথাও নায়ক বৈষ্ণু ও বৈজু বাওরা বলতে দু'জন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। একজন হচ্ছেন আলাউদ্দিন খিলজির সময়কার নায়ক বৈষ্ণু অপরজন রাজা মানসিংহ তোমরের সময়কার বৈজু বাওরা। নায়ক বৈজুকে বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ এবং বৈজু বাওরাকে ধ্রুপদের স্রষ্টা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তবে নায়ক বৈজু এবং বৈজু বাওরাকে আজকাল একই ব্যক্তি বলে মনে করা হয়। বৈজু সুকবি ছিলেন। তিনি বহু ধ্রুপদ রচনা করেছিলেন যার অতি সামান্যই কালে কালে রক্ষা পেয়েছে। উদাসীন বা সন্ন্যাসী প্রকৃতির ছিলেন বলে তাঁকে বৈজু বাওরা' বলা হতো।

সুলতান হুসেন শাহ্ শর্কী (১৪৫৮-১৪৯৯)

আরব্য পারসিক ও তুর্কি সংগীত রীতির সংস্পর্শে এসে ভারতীয় উপমহাদেশের সংগীত ধারায় যে নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল তার প্রধান ধারক ও বাহকদের মধ্যে জৌনপুরের শেষ স্বাধীন নবাব সুলতান হুসেন শাহ্ শরী অন্যতম। তিনি 'বড়ো খেয়াল' (বিলম্বিত লয়ে গীত) গায়ন রীতির উদ্ভাবন করেন। তিনি রাগাঙ্গ রাগের আধারে শ্যাম-রাগাঙ্গের প্রকরণ হিসেবে মলহার শ্যাম, গৌড় শ্যাম, ভূপাল শ্যাম প্রভৃতি বারো প্রকার শ্যাম রাগের উদ্ভাবন করেন। অনুরূপ টোড়ি রাগাঙ্গের জৌনপুরী টোড়ি' বা 'হুসেনী টোড়ি জনপ্রিয় করেন।

রাজা মানসিংহ তোমর (১৪৮৩-১৫১৭)

গোয়ালিয়রের রাজা মানসিংহ তোমর সংগীতের একজন মহান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর দরবারে তৎকালীন শ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ হিসেবে বসু, বৈষ্ণু, ভল্লু, চরজু, ধোভু, রামদাস প্রমুখ প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। রাজা মানসিংহ তোমর ধ্রুপদ গানের সংস্কার করে যুগোপযোগী করেন। সংগীতজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে 'মানকুতুহল' নামে একটি বিশাল সংগীতশাস্ত্র গ্রন্থ রচনা করেন। এতে তাঁর স্বরচিত গানও ছিল। তাঁর স্ত্রী, রাণী মৃগনয়ন ও সংগীতে পারদর্শিনী ছিলেন এবং তিনি 'গুর্জরী টোড়ী রাগটি সৃষ্টি করেন। রাজা মানসিংহ নিজেও কয়েকটি রাগ সৃষ্টি করেন।

চতুর্দশ শতাব্দীর অপর একজন প্রসিদ্ধ সংগীত শাস্ত্রকার ছিলেন লোচন। তিনি 'রাগতরঙ্গিণী' নামে একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর গ্রন্থে তৎকালীন সংগীতের বিশন পরিচয় পাওয়া যায়। উত্তর-ভারতীয় রাগসংগীতের ধারায় লোচন পণ্ডিত ওই যুগের বিশিষ্ট নাম।

সম্রাট আকবরের রাজত্বকাল (১৫৫৬-১৬০৫)

মধ্যযুগে মুঘল শাসনামলে শাস্ত্রীয়সংগীতের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। এই উন্নতির মহান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সম্রাট আকবর। ঐতিহাসিক আবুল ফজল আকবরের দরবারে প্রায় ছত্রিশজন সংগীতজ্ঞের তালিকা করেন। ধ্রুপদ শৈলীর স্বর্ণযুগ খ্যাত তাঁর রাজত্বকাল সংগীতের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ যুগ হিসেবে পরিচিত। এই যুগের শ্রেষ্ঠতম সংগীতায় মিয়া তানসেন রাজদরবারের নবরত্নের শ্রেষ্ঠরত্ন। তাঁর সংগীত পরিবেশনা অদ্যাবধি কিংবদন্তি এবং তানসেনী যুগ হিসেবে প্রশংসিত। তানসেন প্রবর্তিত সংগীত-রীতি 'সেনী ঘরানা' নামে প্রচলিত হয়। তাঁর সৃষ্ট কয়েকটি রাগের নাম হলো দরবারী কানাড়া, মিঞা কী মল্লার, মিঞা কী সারং ইত্যাদি।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল (১৬০৫-১৬২৭)

সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে সংগীতের পৃষ্ঠপোষকতার পূর্বধারাই অব্যাহত ছিল। দরবারের সংগীতবিদদের মধ্যে লাল খাঁ, হাফিজ আলী, তানসেনের পুত্র বিলাস বা, মির্জা জুলকার নাইন, ছত্তর খা, জাহাঙ্গীর দাদ, দুররম দাদ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে পণ্ডিত ব্যঙ্কটমুখী রচিত 'চতুদণ্ডী প্রকাশিকা' গ্রন্থ রচিত হয়। ব্যঙ্কটমুখীর চতুদণ্ডী প্রকাশিকা' রাগ-বর্গীকরণের মেল বা ঠাট পদ্ধতির আলোকে অদ্যাবধি উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় সংগীতে গুরুত্বপূর্ণ

সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকাল (১৬২৮-১৬৫৮)

সম্রাট শাহজাহান অত্যন্ত শিল্পানুরাগী ছিলেন। চিত্রকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, সংগীত সকল বিভাগেই তাঁর পৃষ্ঠপোষকতার অসাধারণ কীর্তি অদ্যাবধি প্রশংসিত। ফকিরুল্লার 'রাগদর্পণ' থেকে জানা যায়, শাহজাহানের দরবারে ত্রিশজন গায়ক-বাদক ছিলেন। মানসিংহ তোমর প্রবর্তিত 'ধ্রুপদ' শৈলী ও হুসেন শাহ শকী প্রবর্তিত * খেয়াল" এসময়ে জনপ্রিয় ছিল। তাঁর দরবারের সংগীতজ্ঞদের মধ্যে ছিলেন- শেখ বাহাউদ্দিন, মিয়া দালু, শের মুহম্মদ, নিরজ, লাল খাঁ, খুনহাল খাঁ, জগন্নাথ কবিরায়, গুণসেন, রঙ্গ খাঁ, মুহিব খাঁ গুজরাটী, বসন্তী কলাবন্ত, সুবল সেন, মিছরি প্রমুখ। সম্রাট শাহজাহান সংগীতজ্ঞনের কৃতিত্বের জন্য কবিরায়, গুণ-সমুদ্র, নায়কই আফজাল ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করেন।

আওরঙ্গজেব (১৬৫৮-১৭০৭) ও সম্রাট বাহাদুর শাহ (১৭০৭-১৭১১ )

আওরঙ্গজেব ও বাহাদুর শাহর রাজত্বকালে সংগীতের রাজদরবারকেন্দ্রিক পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত ছিল। এই সময়ে ভাবভট্ট রচিত কয়েকটি সংগীত বিষয়ক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো- 'অনুপসংগীত' রত্নাকর', 'অনুপপসংগীত বিলাস', 'অনুপসংগীতাঙ্কুশ', 'মুরলী প্রকাশ', 'নষ্টোদিষ্ট প্রবোধক', 'ধ্রুপদের টীকা', সংগীতবিনোদ"। তাঁর গ্রন্থগুলো সংগীতের পূর্বাচার্যদের অনুকরণ হলেও এতে ধ্রুপদ গায়নরীতির সুষ্ঠু পরিচয়, মানাবিধ রাগের সমসাময়িক বর্ণনাদি, অনুপসংগীত রত্নাকরে ২০টি মেলকে আশ্রয় করে রাগ-বর্গীকরণ করা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মুহম্মদ শাহ্ (১৭১৯-১৭৪৮)

বাহাদুর শাহ্র পৌত্র মুহম্মদ শাহ্ একজন দক্ষ সংগীতজ্ঞ ছিলেন। আওরঙ্গজেবের পর তিনিই সর্বশেষ সংগীতপ্রেমী মোগল সম্রাট। তাঁর রাজত্বকাল খেয়াল শৈলীর বিকাশের জন্য ইতিহাসখ্যাত। তানসেনের দৌহিত্র বংশের লাল খাঁর পুত্র নিয়ামত খাঁ (১৬৭০) ওরফে 'সদারঙ্গ' রচিত খেয়াল বন্দিশে মুহাম্মদ শাহ (রঙ্গিলে) নাম নিয়ে একত্রে 'সদারঙ্গীলে' ভণিতাযুক্ত বন্দিশ, খেয়াল শৈলী বিকাশের সাক্ষী হিসেবে অদ্যাবধি বিখ্যাত ও প্রচলিত। 'সদারঙ্গ' বীণাকার তথা ধ্রুপদ ও ধামার গায়ক ছিলেন। সদারঙ্গ সহস্রাধিক খেয়াল, ধ্রুপদ, ধামার বন্দিশ রচয়িতা ও সংগীতজ্ঞ হিসেবে চিরস্মরণীয়।

সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতায়ার্ধে অদারঙ্গের জন্ম। তাঁর আসল নাম ফিরোজ খাঁ। অদারঙ্গ, মুহম্মদ শাহর সভাগায়ক

ছিলেন। তাঁর সৃষ্ট রাগ ফিরোজখানী টোড়ি বহুল প্রচলিত ছিল। অনারঙ্গ বীণাবাদ্যের উন্নয়ন এবং কণ্ঠসংগীতের

অনুকরণে যন্ত্রে আলাপচারিতা প্রচলন করেন।

আধুনিক কালের প্রারম্ভে বা প্রথমার্ধে বা প্রাক-আধুনিক যুগে অর্থাৎ ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রথম দুই-তিন দশক পর্যন্ত ইংরেজ রাজত্বের প্রারম্ভিক পর্বে সংগীতের স্রোত কিছুটা মন্থর হয়ে আসে। কিন্তু সংগীতের অগ্রগতির দ্বার একেবারে রুদ্ধ হয়ে যায়নি, স্তিমিত হয়েছিল মাত্র। জয়পুরের মহারাজা প্রতাপসিংহ (১৭৭৯-১৮৮৪ খ্রি.) একটি সংগীত সম্মেলনের আয়োজন করে সারা ভারতের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞদের সেই সম্মেলনে আহ্বান করে। তাঁদের সহায়তায় 'সংগীতসার' নামে একটি মহামূল্যবান গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। এই গ্রন্থে বিলাবলকে শুদ্ধ ঠাট বলে স্বীকার করা হয়।

১৮১৩ সালে পাটনার রইস মুহম্মদ রজা সাহেব 'নাগমাতে আসফী' সংগীতগ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে বিলাব- লকেই শুদ্ধ ঠাট বলে সর্বপ্রথম প্রচার করেন এবং প্রাচীন রাগ-রাগিণী পদ্ধতির সংস্কার সাধন করে ছয় রাগ, ছত্রিশ রাগিণী নির্ধারিত করেন। আধুনিক যুগের উত্তরপর্বে সংগীতসাধক পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে এবং পণ্ডিত বিষ্ণুদিগম্বর পুলস্করের নাম ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাপর্ব শেষ করে ভাতখতে লুপ্তপ্রায় হিন্দুস্তানি সংগীতের পুনরুদ্ধারে ব্রতী হন।

পণ্ডিত ভাতখণ্ডেই সর্বপ্রথম ১০ ঠাঁট পদ্ধতির প্রচলন করেন এবং এই পদ্ধতি আজ সমগ্র উত্তর ভারতে স্বীকৃত ও প্রচলিত। তিনি একাধিক পুস্তক প্রণয়ন করেন। যথা- 'হিন্দুস্তানি সংগীত পদ্ধতি' (ক্রমিক পুস্তকমালিকা) (৬ খণ্ড), 'লক্ষসংগীত', 'অভিনব রাগমঞ্জরী', 'সংগীতশাস্ত্র' (৪ খণ্ড) ইত্যাদি।

বিষ্ণুদিগম্বর পুলস্কর ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনিও সংগীত প্রচারার্থে সমগ্র ভারত ভ্রমণ করেন এবং

প্রথমে লাহোরে ও পরে মুম্বাই নগরীতে 'গান্ধর্ব মহাবিদ্যালয়' নামে সংগীত-প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। তাঁর লিখিত

একাধিক পুস্তকের মধ্যে 'রাগপ্রবেশ', 'সংগীত তত্ত্ব দর্শক', 'ভজনামৃত লহরী' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

বর্তমান যুগ

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ ও বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বা প্রথম ভাগ থেকে বর্তমান যুগের শুরু। ষোড়শ শতাব্দীকে যেমন ধ্রুপদ শৈলীর স্বর্ণযুগ বলা যায় তেমনি বিংশ শতাব্দীকে খেয়াল শৈলীর স্বর্ণযুগ বলা হয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঠুমরি গান বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ্ ১৮৪৭ সাল থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত অযোধ্যার রাজ্য শাসন করেন। ঠুমরি গানের কেন্দ্রভূমি ছিল লক্ষ্মৌ। রাজ্য শাসনের চেয়ে গান-বাজনার প্রতি তিনি অধিক অনুরক্ত ছিলেন।

ওয়াজেদ আলী শাহ্ আখতার পিয়া' ছদ্মনামে অনেক ঠুমরি রচনা করেন। ঠুমরি গানের সময়ে শাস্ত্রীয়সংগীতের টপ্পা শৈলীটিও লক্ষ্মৌ রাজদরবারে থাকাকালে গোলাম নবী ওরফে শৌরী মিঞা প্রবর্তন করেন।

বিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তি উন্নয়নের ফলে রাগসংগীতের রেকর্ড সহজলভ্য হয়। ফলে বিভিন্ন ঘরানার শিল্পীদের গান বাণিজ্যিকীকরণ হতে থাকে। ঘরানার পরিবর্তে সংগীতজ্ঞদের বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক পৃষ্ঠপোষকতায় উদ্বুদ্ধ করা হয় এবং সংগীত শিক্ষার উদার প্রভাব সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পায়। ভারতবর্ষের প্রায় অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েই সংগীতের একাডেমিক শিক্ষাক্রম চালু রয়েছে। এ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘরানাদার শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে, বিষ্ণুদিগম্বর পঙ্গুক্ষর, ওমকারনাথ ঠাকুর, নারায়ণরাও পটবর্ধন, শংকররাও পণ্ডিত প্রমুখ সংগীতজ্ঞ এবং তাদের শিষ্য-প্রশিষ্য বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক শিক্ষকতার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।

খেয়ালের ঘরানাকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা আজকে দুর্বল হলেও ইতিহাসে এর গুরুত্ব অপরিসীম। গায়কীর দৃষ্টিতে এসব ঘরানার উপযোগিতা বর্তমানে গবেষণার বিষয় হিসেবে গণ্য।

লোকসংগীত

সাধারণত জনশ্রুতিমূলক গানকে লোকসংগীত বোঝায়। অর্থাৎ যে গান শ্রুতি এবং স্মৃতি নির্ভর করে প্রবহমান নদীর ধারার মতো বহমান তাকেই লোকসংগীত বলা হয়। লোকসংগীতের আদি উদ্ভব প্রাগৈতিহাসিক মানব সমাজে। প্রকৃতির মায়া ঘেরা অনাবিল সৌন্দর্যের অন্তর্গত এই লোকসংগীত যেকোনো লোকের কাছে অতি প্রিয় এবং আকর্ষণীয়।

লোকসংগীত মূলত গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও এতে একদিকে রয়েছে আঞ্চলিক মানস সংগঠনের পরিচয় এবং অন্যদিকে পল্লিগ্রামের চারপাশের পরিবেশনের ধ্যান-ধারণা। লোকসংগীত আধুনিক যেকোনো সংগীতের মতোই বাণী ও সুরের সমন্বিত রূপ। তবে এই সংগীতের বাণী ও ভাষা আঞ্চলিকতায় পরিপূর্ণ এবং সুরও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। আবার সময় ও স্থানের পরিবর্তনে লোকসংগীতের বিষয়বস্তুতেও পরিবর্তন আসে। আবার সমাজ ও সংস্কৃতির পরিবর্তনে এই গানের কাঠামোগত পরিবর্তন আসে।

লোকসংগীত সাধারণত একটিমাত্র ভাব বা বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। কিন্তু বাংলাদেশে কাহিনিভিত্তিক

লোকগীতির সংখ্যাও কম নয়। এগুলো কাহিনি ও বর্ণনা গানের সমন্বয়ে গঠিত। লোকগীতি বা লোকসংগীত

সাধারণত লিখিত নয় বলে একজন মানুষের কণ্ঠ থেকে ভিন্ন মানুষের কণ্ঠে একই সংগীত পরিবর্তিত হয়ে থাকে।

আবার সমাজ ও সংস্কৃতির বিবর্তনে গানেরও কাঠামোগত পরিবর্তন হচ্ছে। এমনিভাবে লোকগীতি বা লোকসংগীত

পরিবর্তন সাপেক্ষে প্রাচীনকাল থেকে অদ্যাবধি পরিবর্তিত হচ্ছে। মুখে মুখে গান রচনা করলেও লোকসংগীত

রচয়িতার সামনে থাকে তার আপন পারিপার্শ্বিক ভুবন, যেমন- নদ-নদী, খাল বিল, মাঠ-ঘাট, বন-বনানী,

উদার নীল আকাশ, জীব-জন্তু ও ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য।

লোকসংগীত সর্বদাই যৌগ সৃষ্টি। ফলে ব্যক্তিগত রচয়িতার খোঁজ পাওয়া যায় না। লোকসংগীত এবং পল্লিগীতির মধ্যে এখানেই খানিকটা পার্থক্য বিদ্যমান। যেমন- পল্লিগীতি রচয়িতা ও সুরকারের পরিচয় বা সন্ধান পাওয়া যায় কিন্তু লোকসংগীত রচয়িতা এবং সুরকারের সন্ধান পাওয়া যায় না। তাই বলা যায় যে লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে আসা গানই লোকসংগীত। কেননা, এখানে অনেক সময় রচয়িতা এবং সুরকারের সন্ধান পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশের লোকসংগীত ভাঙার অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী। বাংলাদেশের লোকসংগীতের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন শ্রেণিভুক্ত গান। যেমন- ভাটিয়ালি, জারিগান, সারিগান, বারোমাসি, কবিগান, কীর্তন, বাউলগান, ধূয়াগান, ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা, ঝুমুরগান, পাঁচালি, জাগগান, বিয়ের গান, মুর্শিদি, মারফতি, মাইজভাণ্ডারী, গাজীরগান, চট্‌কা গান, ভাদু গান, টুসু গান, ময়মনসিংহগীতিকা ইত্যাদি।

ভাটিয়ালি গান

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। লোকসংগীতের বিভিন্ন ধারার মধ্যে ভাটিয়ালি একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ভাটিয়ালি গান নদীবহুল বাংলাদেশের আদিবাসীদের সৃষ্টি। এই গানের সুর অতি সহজেই সরলপ্রাণ মানুষের হৃদয়কে আকৃষ্ট করে। নৌকার মাঝির কণ্ঠে ভাটির টানে নৌকা নিয়ে চলার সময় যে সুর বের হয়ে আসে সেটাই ভাটিয়ালি সুর। ভাটিয়ালি গান নদীর গান। নদীর যোগাযোগের মাধ্যম হলো নৌকা। ভাটিয়ালি শব্দটির সাথে নদীর স্রোত ভাটির দিকে প্রবাহিত হওয়ার একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। ভাটির টানে যখন নৌকা চলে তখন মাঝিকে শ্রম দিতে হয় না। তখন সে লম্বা টানে দরাজ কণ্ঠে এই গান গাইতে থাকে। এ গান প্রধানত ব্যক্তিকেন্দ্রিক। ব্যক্তি মনের বেদনা ও সুখ-দুঃখের চিত্র এ গানের বিষয়বস্তু। ভাটিয়ালি গানের বাণী নদীকেন্দ্রিক, এই গানের সুর নদীর স্রোতের মতো প্রবহমান। আধুনিক যুগে বেতার, টেলিভিশন এমনকি ছায়াছবিতেও ভাটিয়ালি গান পরিবেশিত হচ্ছে। ভাটিয়ালি গানের উদাহরণ তুলে ধরা হলো:

মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে আমি আর বাইতে পারলাম না।

ভাটিয়ালি গানের যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ করা যায় লোকসংগীতের বিভিন্ন ধারায়। আধুনিক সাহিত্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং পল্লিকবি জসীম উদ্‌দীন ভাটিয়ালি গানের মাধুর্যে অনুপ্রাণিত হয়ে যেসব গান রচনা করেছিলেন তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন 'গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ" নজরুল লিখেছেন 'আমার গহীন জলের নদী" আবার পল্লিকবি জসীমউদ্দীন লিখেছেন 'নদীর কূল নাই কিনার নাইরে' ইত্যাদি।

ভাটিয়ালি গানের প্রধান উৎপত্তি স্থল সিলেট ও ময়মনসিংহের বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চল। পরে এ গানের বিস্তৃতি ঘটে

অন্যান্য নদী বহুল এলাকায়। যেমন- ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, কুমিল্লার পশ্চিম অঞ্চল, চাঁদপুর, মতলববাজার,

ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলে।

জারিগান

বাংলাদেশের লোকসংগীতের একটি মূল্যবান সম্পদ হলো জারিগান। জারি শব্দের অর্থ কান্না বা শোক। একটি সমন্বিত কাহিনি এ গানের বৈশিষ্ট্য। প্রধানত কারবালার যুদ্ধের বিষাদময় ঘটনাকে এখানে বর্ণনা করা হয়। তবে কারবালার প্রসঙ্গ ছাড়াও আরও বিভিন্ন বিষয়ে জারিগান রচিত হতে দেখা যায়।

অনুমান করা হয়, সামন্তযুগের গোড়ার দিক থেকেই শক্তিমান শাসকের জয়-পরাজয় প্রভৃতি ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্রাম্য কবিরা এ ধরনের গান রচনা করা শুরু করেন। পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্মের আগমনের সাথে ইসলামের বীরত্ব, ত্যাগ ও প্রেম-কাহিনি আরবি-ফারসি সাহিত্যের পথ ধরে আবেগপ্রবণ বাঙালি সমাজে প্রচারিত হয় এবং গ্রাম্য চারণ কবিরা তাদের মনের আবেগ ও মাধুরী মিশিয়ে রচনা করেন বীরগাথা, করুন গাথা ও প্রেম গাথা। যেমন: কারবালার বিষাদময় ঘটনা নিয়ে রচিত হয় মর্সিয়া জারি, আইয়ুব নবী ও তার বিবি রহিমাকে নিয়ে রচিত হয় আইয়ুব নবীর জারি এবং নবী ইব্রাহীম খলিলুল্লাহকে নিয়ে রচিত 'কোরবানীর জারি'।

আরিগান সাধারণত বিভিন্ন আসরে পরিবেশিত হয়। আসরে জারির সাথে ধুয়া, পাঁচালি, ছড়া ইত্যাদি সহকারে পরিবেশিত হয়। জারিগানের সুর নির্দিষ্ট কিন্তু কথা বা বিষয়বস্তু নির্দিষ্ট নয়। নাচ সহযোগে জারিগান পরিবেশিত হয়। একজন মূল গায়ক বা বয়াতী গানের ভেতর দিয়ে কাহিনি পরিবেশন করেন, সাথে সহযোগী গায়ক ধুয়া ধরে গানকে অগ্রসর হতে সাহায্য করে। জারি গারকগণ শোকের প্রতীক হিসেবে গায়ে কালো পোশাক ও হাতে রুমাল ব্যবহার করেন। যেমন- ইসমাইলের কোরবানির জারি-

এক রোজ খলিলুল্লাহ্ নিদ্রাতে ছিল

ঘুমের ঘোরে খোদা তাকে কহিতে লাগিল

আল্লা বলে ইব্রাহীম শোন আমার বাণী। আমার নামেতে তুমি করহ কোরবানী।

সারিগান সারিগান লোকসংগীতের একটি বিশেষ ধারা। সাধারণভাবে মাঝিরা নৌকা বেয়ে যাওয়ার সময় সম্মিলিতভাবে যে গান গায় তাকেই সারিগান বলা হয়। এ গানে প্রধান তাৎপর্য হলো সারিবদ্ধভাবে বা একত্রে কাজ করার সময় এই গান গাওয়া হয় অর্থাৎ কর্ম যেখানে সারিগান সেখানে।

সারিগান মূলত নৌকা বাইচের গান। নৌকা বাইচের সময় সারিগান পরিবেশিত হয়ে থাকে। ময়মনসিংহের হাওর অঞ্চল বিশেষ করে পূর্ব ময়মনসিংহ, ঢাকা, বরিশাল ও পাবনা নৌকা বাইচের জন্য প্রসিদ্ধ। এ গান নদীমাতৃক বাংলাদেশের নিজ সৃষ্টি। আদিকাল থেকেই বাংলাদেশের বিচিত্র রকমের নৌকা তৈরি হতো। চলন্ত নৌকার বৈঠার তালে তালে কথা সাজিয়ে আদিম সমাজ থেকেই বাংলায় সারিগানের সৃষ্টি হয়ে থাকবে। বাইচে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এর তিনটি স্তর থাকে। যেমন: নৌকা ছাড়ার বন্দনা গান, বাইচ শুরু হলে উদ্দীপনামূলক সারিগান এবং সব শেষে বিদায় সংগীত। গানগুলো গ্রাম্য কবিদের রচিত সারিগান নিম্নরূপ: ভাইরে শালটি কাঠের ডিঙ্গাখানি

কড়ি কাঠে দাঁড় জমসের আলীর বাইচের নৌকা

গলাত সোনার হার।

বারোমাসি

বছরের বারো মাসের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আকাঙ্ক্ষা-নিরাশার কথা বারোমাসি গানে বর্ণনা করা হয়। বারোমাসি গান প্রত্যেক মাসের বর্ণনা দেওয়া হয় বলে বারোমাসি গান। এই গান শুরু হয় সাধারণত বৈশাখ মাসের বর্ণনা দিয়ে এবং শেষ হয় চৈত্র মাসের বর্ণনা দিয়ে। এ গানের বর্ণনাকার অধিকাংশ সময়েই নারী, যে বারোমাসের প্রাকৃতিক বর্ণনাসহ তার দুঃখ-যন্ত্রণার কথা বলে। বারোমাসি গানের উদাহরণ নিম্নরূপ:

জ্বালাইলে যে জ্বলে আগুন নিভানো বিষম দায়।

আগুন জ্বালাইসনা আমার পায়। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই বারোমাসি গান জনপ্রিয়। বারোমাসি গানগুলো সামাজিক এবং ঐতিহাসিক দিক থেকে বিশেষ মূল্যবান ।

কবিগান

বাংলাদেশের লোকসংগীতের এক বিশিষ্ট ধারার নাম কবিগান। অনুমান করা হয়, রচনা শক্তি, সুর, লয়, তাল, অলংকার সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান ও বাক্য বিন্যাসে পারদর্শী বলে এই গানের স্রষ্টাকে কবিয়াল বলে সম্বোধন করা হয়। বাক্যবিন্যাস, যথার্থ শব্দ প্রয়োগ, উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা এই গানের স্রষ্টা। জনপ্রিয় কোনো ঘটনা, পৌরাণিক প্রসিদ্ধ কাহিনি এবং ধর্মীয় বিষয়বস্তু নিয়ে এই গান তাৎক্ষণিকভাবে রচনা করা হয়। কবিগান - এমন এক ধরনের গান যা সৃজনশীলতা, কবি প্রতিভা এবং সংগীত সাধনার এক অপূর্ব সমন্বয়।

কবিগান দুই দলের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলকভাবে অনুষ্ঠিত হয়। আসরে প্রশ্নোত্তর ও জয় পরাজয়ের ব্যবস্থা থাকে। প্রতিদলে একজন করে দলপতি থাকেন। কয়েকজন গায়ক থাকেন সহযোগিতাকারী হিসেবে। তাদের বলা হয় দোহার। তারা প্রধানত ধুয়া অংশটুকু পেয়ে থাকেন। ঢোল ও কাঁসর এ গানের প্রধান বাদ্যযন্ত্র ।

আঠারো শতকের দিকে কবিগানের পূর্ণ সমৃদ্ধি ঘটে। কবি গানের বিষয় পৌরাণিক হলেও এর প্রসার ঘটেছে আধুনিক কালে। এর বিষয়বস্তুর মধ্যে প্রবেশ করেছে সমসাময়িক অর্থনীতি ও সামাজিক বিষয়াদি। এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের কবি রমেশ শীল গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। রমেশ শীল কবিগানকে আধুনিক ও প্রগতিশীল জীবন চিন্তার সঙ্গে যুক্ত করেন। তাঁর গান হয়ে ওঠে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামের বাণী প্রচারের প্রতীক। এতদিন কবিগান যদিও পৌরাণিক বিষয়াদির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল কিন্তু আধুনিক কালে কবিগান জোতদার বনাম কৃষক, মহাজন বনাম খাতক, এমনকি ধনতন্ত্র বনাম সমাজতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়কে কবি লড়াইয়ের বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচন করা হচ্ছে।

বাউলগান

বাউলগান বাংলাদেশের লোকসংগীতের একটি প্রধান ধারার নাম। বাউল সাধকদের দ্বারা রচিত গানকেই বলা হয় বাউলগান। বাউল সাধনার মূল বিষয় হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের আওতাভুক্ত না থেকে স্রষ্টার সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা। বাউল সম্প্রদায় এক প্রকার অধ্যাত্মবাণী ও উদার মানবতাবাদী সম্প্রদায় হিসেবেও পরিচিত। বাউল সাধনার মাধ্যমে প্রেমের নৈকট্যের মধ্য দিয়ে অসীমের সীমাকে আয়ত্তে আনেন। বাউলগানে ধর্মনিরপেক্ষতার বাণী প্রচারিত হয়। মানুষ তাদের কাছে বড়ো।

বাউলগানের মধ্য দিয়ে বাউলদের ধর্ম ও শাস্ত্রের মূল বিষয়বস্তুগুলো প্রকাশিত হয়। সাধারণত বাউলরা গানের

কথার মাধ্যমে তাদের তত্ত্ব-কথা প্রকাশ করে। প্রায় সকল বাউলগানেই দেখা যায় সহজিয়া বাদ এবং

শূন্যবাদের কথা। বাউল সাধনার শ্রেষ্ঠ সম্রাট লালন শাহ। লালন ছিলেন উদার মানবতাবানী। লালনের ধর্ম ছিল

মানব ধর্ম। মধ্য যুগের বৈষ্ণব কবি যেমন গেয়েছেন 'সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই”। তেমনি

বাউল সম্রাট লালনের কাছে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ ছিল না।

বাউল শুধু গান নয়, এক প্রকার সুরও। রবীন্দ্রনাথ এই সুরে মুগ্ধ হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গানের সুরের মধ্যে বাউল সুরের প্রভাব লক্ষ করা যায়।

খঞ্জরি, ডুগডুগি, খমক ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গতে বাউলগান গাওয়া হয়ে থাকে।

যদিও বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই বাউলগান প্রভাব বিস্তার করেছে তবুও কুষ্টিয়া জেলায় এ গানের বিকাশ ঘটেছে

বলে মনে হয়। বাউল গান নিম্নরূপ:

১। পাখি কখন জানি উড়ে যায়। একটা বদ হাওয়া লেগে খাঁচায়।

২। কেন জিজ্ঞাসিলে খোদার কথা দেখায় আসমানে

খোদা আছেন কোথায় স্বর্ণপুরে

কেউ নাহি তার সন্ধান জানে।

জাগগা

জাগগান গল্প বা কাহিনিমূলক। লোকজীবনে প্রচলিত গল্প কাহিনি এ গানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়। রাত জেগে এই গান গাওয়া হয় বলে এই গানের নাম জাগদান। রংপুর অঞ্চলে জাপগানের বিশেষ প্রচলন আছে।

অনেক সময় প্রচলিত জনশ্রুতির পীর-দরবেশ ও সাধু-ফকিরদের মাহাত্ম্য এ গানে বর্ণিত হয়। আবার অনেক সময় রাধাকৃষ্ণ ও চৈতন্য দেবকে নিয়েও এই গান রচিত হয়। পৌষ মাসে ফসল ঘরে ওঠে গেলে কৃষক একটু অবসর পায় এবং তখন ফসল ওঠার পর মাঠ শুকনো থাকে। এ সময়ই গ্রামে জাগপানের আসর বসে।

বিয়ের গান

বিয়ে সামাজিক জীবনের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। বিয়েরগান ব্যবহারিক বা আনুষ্ঠানিক গীতি পর্যায়ের গান। বিয়ে কেবল একটি ব্যক্তিগত কিংবা শুধু পারিবারিক অনুষ্ঠান নয়। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সমাজভুক্ত সকলেই এই আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে।

বিয়েকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানগুলো যেমন: পানচিনি, গায়ে হলুদ, মেহেদি তোলা, বর স্নান, বরণ ডালা ইত্যাদি এসব অনুষ্ঠানের প্রতিটিতেই গান পরিবেশন করা হয়। এইভাবে প্রত্যেক বিয়ের প্রত্যেক আচার-অনুষ্ঠানে বিষয়ভিত্তিক বিয়ের গান পরিবেশন করা হয়। বিয়ের গান নিম্নরূপ: ওরে কান্দিয়া পোহাইস নিশি তুই।

হলুদ মাখিয়া অঙ্গে দেখেক চক্ষু তুলি

কারবা হিয়া বুঝিরে ওরে পেন্দেক হলদি অঙ্গ ভরি।

মুর্শিদি গানের উৎপত্তি স্থল চট্টগ্রাম। পরে এর প্রসার ঘটেছে নোয়াখালি ও কুমিল্লা। দেশের অন্যান্য এলাকায়ও কমবেশি মুর্শিদি গানের প্রচলন দেখা যায়। মুর্শিদ অর্থ পথ প্রদর্শক। যিনি স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যস্থকারী। আরবি ইরশাদ শব্দটির অর্থ নির্দেশ। যিনি ইরশাদ বা নির্দেশ দেন তাকে মূর্শিদ বলে। সে অর্থে মুর্শিদকে শুরু বলা যেতে পারে। এই মুর্শিদ বা গুরুর প্রতি ভক্তিবিষয়ক সংগীতই হলো মুর্শিদি গান। সুফি-সাধকগণ এই গীতধারার এটা। মুর্শিদি গান নিম্নরূপ।

ও মুরশিদ পথ দেখাইয়া দাও আমি যে পথ চিনিনা গো

সঙ্গে কইরা নাও |

মারফতি

মারফত শব্দের অর্থ মাধ্যম। স্রষ্টাকে প্রেমের মাধ্যমে অর্জনই এর মূল লক্ষ্য। এই পথের মতাদর্শীরা সাধারণ

মানুষের চিন্তা ও চেতনার অনেক উর্ধে। নিরাকার সৃষ্টিকর্তাকে বিধিবদ্ধ সাধারণ নিয়ম বা উপাসনায় অর্জন নয়, প্রেমের মধ্য দিয়ে আশেক ও মাতকের সর্ম্পকের মাধ্যমে তাকে অর্জন করাই এর উদ্দেশ্য। এই পথ মতে স্বর্ণের লোভ মুখ্য নয়, মুখ্য স্রষ্টার সান্নিধ্য। তবে এই মতের মতাদর্শ বা জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে একজন মাধ্যমের প্রয়োজন হয়, তিনিই 'মুরশিদ', এই মতের জ্ঞানতাপস তিনি। তিনিই স্রষ্টাকে পাওয়ার প্রেমের পথের শিক্ষা দেন। স্রষ্টাকে অর্জনের চারটি পথ আছে, পর্যায়ক্রমে শরিয়ত ত্বরিকত, হকিকত ও মারফত। সবচেয়ে উর্ধ্বে হলো মারফত, তবে এ পথে গোপনীয়তা বেশি। আত্মশুদ্ধি ও আত্মার উৎকর্ষতা এবং উন্নতির মধ্য দিয়ে মানুষ পৌঁছে যেতে পারে অভিষ্ট লক্ষ্যে। তখন সৃষ্টি ও স্রষ্টার মাঝে কোনো ভেদ থাকে না। প্রেম ও সাধনায় সৃষ্টি জয় করে পৃষ্টাকে। এই জয়ের পথ প্রদশর্ক 'মুরশিদ। তিনিই মাধ্যম, তাকে জয় করা অর্থই পরমাত্মাকে জয় করা।

মাইজভাণ্ডারী

মাইজভাণ্ডারী এক প্রকার অধ্যাত্মিক পান। চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার একটি গ্রামের নাম মাইজভাণ্ডার। মাইজভাণ্ডার গ্রামের নামানুসারে এই গানের নামকরণ করা হয়েছে। মাইজভাণ্ডারী গান ও তরিকার মূল ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন সৈয়দ আহমদ উল্লাহ্। তিনি এখন থেকে প্রায় দুইশত বৎসর পূর্বে (১৮২৬ খ্রিঃ) মাইজভাণ্ডার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার তরিকার মূল বিষয় হচ্ছে সংযম সাধনা। অপ্রয়োজনীয় কাজ ও কথা পরিহার করা, বিলাস বৈভব পরিহার করা এবং সমালোচনাকারীদের শত্রু না ভেবে উপকারী বন্ধু ভেবে আত্মশুদ্ধি করা। ১৯০৬ সালে ৭৯ বৎসর বয়সে এই মহান সাধক মৃত্যুবরণ করেন।

মাইজভাণ্ডার গানের মর্মে মর্মে ধ্বনিত হয় পরম ভক্তির সাথে মিলনের সাথে ব্যাকুলতা। এ ধরনের ভক্তিবান গান মুর্শিদি ও মারফতি গানের মূল বিষয়। মারফতি ও মুর্শিদি গানের আবেগই মাইজভাণ্ডারী গানের উৎপত্তি। মাইজভাণ্ডারী গানের বাণী শ্রোতার মনে অধ্যাত্ব চেতনার সৃষ্টি করে। মাইজভাণ্ডার তরিকায় 'সেনা' (সংগীতের তালে জিকির) অর্ন্তভুক্ত থাকায় অসংখ্য ভক্ত ও অনুরক্তদের দ্বারা বিপুল সংখ্যক মাইজভাণ্ডারী গান রচিত হয়ে গেছে। মাইজভাণ্ডারী গান এখন শুধু চট্টগ্রামে মাইজভাণ্ডার গ্রামেই সীমাবদ্ধ নয়। এ গান আজ বাংলাদেশের সমস্ত মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত মাইজভাণ্ডারী গান নিম্নরূপ :

চল মন ডুৱাই যাই

বিলম্বের আর সময় নাই গাউছুল আযম মাইজভাণ্ডারী স্কুল খুইলাছে।

গাজীৱগান

বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের মুসলমানেরা গাজী পীরকে মান্য করে। 'গাজীর পট' নামে এক প্রকার পট আছে। পটুয়ারা বাঘের ছবি সম্বলিত গাজীর পট নিয়ে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে গাজী পীরের মাহাত্ম্যমূলক গান গায়। গাজী পীরের গান বা গাজীর গান একজন গায়কের সঙ্গে কয়েকজন দোহার নিয়ে পরিবেশিত হয়। এই গানে ঢোল, খোল, মন্দিরা ইত্যাদি বাজানো হয়। গাজী পীরকে নিয়ে নানা প্রকারের জনশ্রুতি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে আছে।

চটকাগান

চটকাগান বাংলাদেশের সংগীতের একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গান। এই গানের রচনা রীতিতে সমাজের প্রতি উপহাস ও ব্যঙ্গাত্মক ভাব রয়েছে। চটকা খুব সরল ছন্দের গান। বাংলাদেশের দিনাজপুর ও রংপুর জেলাতে চটকা গানের প্রচলন বেশি দেখা যায়। এই গানের বিষয়বস্তু অতি সাধারণ। সহজ সরল কথা ও ছন্দের মধ্য দিয়ে সামাজিক চিত্র ফুটে ওঠে। চটকা গানের সুর চটুল। এই গানের গতি দ্রুত।

টুসুগান বীরভূম অঞ্চলের একটি বিশেষ পর্বের নাম “টুসু'। এই ‘টুসু পূজা' উপলক্ষে যে বিশেষ গানগুলো গাওয়া হয় তাকেই বলা হয় টুসুগান। ভানুগান

"ভানুগান’পূজার গান। ভদ্রেশ্বরী দেবীকে উপলক্ষ করে সারা ভাদ্র মাসে যে গান গাওয়া হয় তাকে ভাদুগান বলে। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম, বাঁকুড়া, কুচবিহার অঞ্চলে এই গানের প্রচলন রয়েছে।

ভাওয়াইয়া গানের উৎপত্তি হিমালয়ের পাদদেশীয় তরাই অঞ্চল, জলপাইগুড়ি ও কুচবিহার জেলায়। তবে বাংলাদেশের রংপুর, দিনাজপুর প্রভৃতি অঞ্চলেও এই গানের প্রচলন বেশি দেখা যায়। "ভাব" থেকে ভাওয়াইয়া শব্দটির উৎপত্তি। ভাওয়াইয়া গান দোতারার গান নামেও পরিচিত। গরুর গাড়ির গাড়োয়ানের কন্ঠেও এই গান শোনা যায়। আবার দেখা যায় মহিষের পিঠে চড়ে বেড়ানোর মূহুর্তে তারা গান বাঁধে এবং সুর পেয়ে ওঠে আপন মনে। ভাওয়াইয়া গান বেশির ভাগই আঞ্চলিক কথা ও সুরে রচিত হয়। এ গান এক বিশেষ চঙ্গে গলার স্বরকে ভেঙে গাওয়া হয়। ভাওয়াইয়া গানে কয়েকটি প্রকার লক্ষ্য করা যায়। যেমন- মৈষাল বন্ধুর গান, মাহুত বন্ধুর গান, চটকা, ক্ষীরোল, বারোমাইসা, চিতান, গড়ান প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

পাঁচালি

পাঁচালির বিষয় হচ্ছে দেব-দেবীর বন্দনা। বাংলাদেশের আদিকালে পাঁচটি পদযুক্ত 'পঞ্চ ভালেশ্বর' নামক এক প্রকার গীতি প্রচলিত ছিল। ক্রমে পঞ্চ ভালেশ্বর 'গীতি লোপ পায় ও তা থেকে পাঁচালি' নামক গীতির উৎপত্তি ঘটে। তবে পাঁচালির নামকরণের ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। “পাঁচালি' গানের মূল হিসেবে ধরা হয় দাশরথি রায়কে। তিনি পাঁচালিকে রাগসংগীতের সাথে যুক্ত করেন এবং সুর ভঙ্গিতে পাঁচালি পরিবেশনের রীতি প্রচলন করেন। তবে বর্তমানে সহজ সুরে আবৃত্তি করা যায় এমন এক প্রকার গীতিকে পাঁচালি বলা হয়ে থাকে।

গম্ভীরা গম্ভীরা গানের আদি উৎপত্তিস্থল পশ্চিম বঙ্গের মালদহ অঞ্চলে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর মালদহ এলাকা থেকে কিছু মুসলিম পরিবার রাজশাহীর নবাবগঞ্জ এলাকায় বসত গড়ে তোলে। রাজশাহীর জেলা সদর, নাটোর জেলা ও নবাবগঞ্জ এলাকা বাংলাদেশে গভীরা অঞ্চল রূপে রূপান্তরিত হয়েছে।

'গম্ভীরা' শব্দটির অর্থ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রকোষ্ট। কিন্তু গান পরিবেশনার সাথে এই অর্থের কোনো মিল পাওয়া যায় না। গম্ভীরা গানের বিষয়বস্তু মূলত বর্ষ বিবরণী পর্যালোচনা। সাধারণত বছরের শেষ দিন (চৈত্রমাসে) এই গানের অনুষ্ঠান হয়। আবার নতুন বছরের শুরুতে (বৈশাখ মাসে) এ গান পরিবেশনের রীতি প্রচলিত আছে। এই উপলক্ষে বছরের প্রধান প্রধান ঘটনাবলি গানের মাধ্যমে আলোচিত হয়। চৈত্র সংক্রান্তি উৎসবে শিবের বন্দনার উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত হয়। তবে এই বন্দনার মধ্যে থাকে লৌকিক জীবন। বর্তমানে সামাজিক অবস্থা সাংসারিক অভাব অনটন; এমন কি রাজনৈতিক হালচালও গম্ভীরা গানে বর্ণিত হতে দেখা যায়। তেমন একটি গানের অংশবিশেষঃ

কাম কাজ না করিলে

মান রাহেনা হে ভোলা নানা দেখ দুই দিন যদি বসে থাকি ভোলা নানা নানা হে।

ঝুমুর গান

সাঁওতাল জাতির নাচের নাম ঝুমুর। সাঁওতালদের সঙ্গে বাংলা লোকসংগীতের সংস্কৃতি ও সংযোগ ঘটলে ঝুমুরের ধারা বাংলা লোকসংগীতকে প্রভাব বিস্তার করে। সাঁওতালদের ঝুমুর থেকে বাংলা ঝুমুরের উৎপত্তি হলেও ক্রমে বাংলা ঝুমুরের ধারায় পরিবর্তন আসে। বাংলা ঝুমুরে রাধা-কৃষ্ণের আখ্যান কাহিনি প্রধান

বিষয়বস্তু।

থুয়াগান

পাবনা, ফরিদপুর, যশোর, ঢাকা প্রভৃতি অঞ্চলে ধুয়া গান বিশেষভাবে প্রচলিত। ধুরাগান একক বা দলবদ্ধ উভয়ভাবেই গাওয়া হয়। কখনো দুই দলে পাল্লা দিয়ে এই গান পরিবেশন করা হয়। বাংলা প্রকৃতিই এদেশের মানুষকে করেছে স্বভাব কবি। এ গানে অনেক সময় সামাজিক অবস্থার দোষত্রুটি তুলে ধরা হয়। ধুয়াপানে দুজন বয়াতি বা পায়েন থাকেন। এদের একজন প্রশ্ন করেন এবং অপরজন উত্তর দেন। অনেক সময় উত্তর দাতা পাল্টা প্রশ্নও করেন।

ধুয়াগান কবি গানের সাথে কিছুটা মিল পাওয়া যায়। এ গানে ধর্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, মানবতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে গীতি কবিরা তাদের গ্রামীণ সরলতা প্রকাশ করে থাকেন। সামাজিক ব্যাভিচার, অন্যায়-অবিচারও তাদের আলোচনায় এসে থাকে। বাঙালির বিভিন্ন লৌকিক উৎসবের গীতিতেও ঝুমুরের প্রভাব পড়ে। যেমন-পাড় শালিয়ার ঝুমুর খেমটি ঝুমুর, পাতা নাচের ঝুমুর, বারস নাচের ঝুমুর প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ময়মনসিংহ গীতিকা

ময়মনসিংহ গীতিকা লোকসংগীতের অন্যতম প্রধান ধারা। ময়মনসিংহ জেলা বাংলার লোকসাহিত্যের তথা লোকসংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য আসন জুড়ে রয়েছে। এই অঞ্চলের প্রত্যেকটি গাথাই এক একটি রত্ন বিশেষ। এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য গাথাগুলোর মধ্যে রয়েছে- মহুয়া, মলুয়া, কবি-চন্দ্রাবতী, রূপবতী ইত্যাদি।

ড. দীনেশ চন্দ্র সেন, চন্দ্রকুমার দে প্রমুখ সংগ্রাহকগণ উক্ত অঞ্চল থেকে এই মূল্যবান গাথাগুলো সংগ্রহ

করেছেন। এই গাথাগুলোতে চারশত ও পাঁচশত বৎসর পূর্বের তখনকার সমাজচিত্র খুব স্পষ্টভাবেই ধরা পড়ে।

শুধু তাই নয় নিরক্ষর পল্লিকবিদের অপূর্ব কাব্যশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। এই গাথাগুলো শুধুমাত্র কাব্য

প্রতিভারই সাক্ষ্য বহন করে না; এই গাথাগুলোতে অপূর্ব নাট্য উপাদানও লক্ষ করা যায়। গাথাগুলোর আঞ্চলিক

সুর বংশপরম্পরায় ময়মনসিংহ অঞ্চলের গ্রামে-গ্রামে অদ্যাবধি গীত হয়ে আসছে।

Content added By
Promotion